তিন তাসের ভেল্কিবাজি। রাস্তাঘাটে, রেল লাইনে। দূর থেকে পথচারীকে লক্ষ্য করে ঝটপট ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে
বসছে জুয়াড়িরা। ৮ থেকে ১২ জনের সংঘবদ্ধচক্র। নানা কৌশলে জুয়ায় আকর্ষণ করছে সাধারণ মানুষকে। দু’তিনগুণ লাভ জেতানোর লোভ দেখিয়ে টানছে জুয়ার আসরে। এক-দুই-তিন বা ততধিক চালে কিছুক্ষণের ব্যবধানে হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। তারপর হওয়া জুয়ার আসর। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই জমে উঠছে নতুন শিকারের আসর। এভাবে রাজধানীর অন্তত অর্ধশতাধিক পয়েন্টে দিনে ও রাতে চলছে জুয়ার ফাঁদ।
কাওরান বাজার রেললাইন। ৬ই মার্চ সকাল সাড়ে ১১টা। রেল লাইন ধরে তেজগাঁওয়ের দিকে যাচ্ছিলেন আবু রায়হান। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। কিছুটা দূর থেকে তাকে দেখেই টার্গেট করে এক জুয়াড়ি। মুখে গোঁফ। ছোটখাটো ফর্সা দেহ। তার পাশেই প্রায় একই গড়ন ও বয়সী অপর সহযোগী হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুয়ায় হারানো ৫০০ টাকা ফেরত পাওয়ার চেষ্টার অভিনয় তার। আবু রায়হান কাছে আসতেই সেই সহযোগীর অনুনয়-বিনয়ের সুরে নালিশ, ‘আমি বুঝতে পারিনি। আমি আর খেলবো না। বাজার না নিয়ে গেলে মালিক আমাকে মেরে ফেলবে। ভাই, আমার টাকাটা এর কাছ থেকে নিয়ে দিন। ভুল খেলে সে আমার টাকা নিয়ে ফেলেছে। ইত্যাদি।’ কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই নিজের অজান্তে ফাঁদে পা পড়লো আবু রায়হানের। ততক্ষণে দক্ষ জুয়াড়ির বেশে হাজির আরেক ‘ত্রাণকর্তা’। এসেই সে কারও কাছে টাকা থাকলে নতুন চালে লাভ করিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। কার্ডগুলো ভালোভালে পর্যবেক্ষণ করে রাণীর ছবি সম্বলিত কার্ডটির (যে কার্ডে টাকা বাজি রাখলে লাভ জেতা যায়) একটি কোনা ভেঙে দিলো। তা অনুসরণ করার জন্য ইঙ্গিত করলো আবু রায়হানের প্রতি। এতে আবু রায়হানের জেতার প্রত্যয় জাগে। এরপর ওই জুয়াড়ির কয়েকটি ডামি চালে বাজিও জিতে। তবে তখন ধীরে হাত চালানোয় সেই ডামি বাজিতে আবু রায়হানের বাজিও প্রায় সঠিক ছিল। তাতে তার মনেও আত্মবিশ্বাস জন্মে। বাজারের টাকা খোয়ানোর লোকটির প্রতি তার মনে দয়া জাগে। তাকে হারানো টাকা উদ্ধার করে দেয়ার জন্য জুয়াড়িদের কথার ভুলে নিজেই জুয়ায় নেমে পড়ে। আর ওই দক্ষ নেশাখোর জুয়াড়ি বারবার বলে যাচ্ছিল, ‘ভাই, কারও পকেটে টাকা থাকলে বাজি ধরুন। এখনই উদ্ধার করে দিচ্ছি। এ কার্ডে টাকা ধরুন।’ কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আবু রায়হানের চারপাশে অন্তত ১২-১৪ জন লোকের জটলা। প্রথমে তাদের পথচারী হিসেবেই ভাবে। তারাও ভুল চালে উদ্বুদ্ধ করছে। প্রথম চালেই আবু রায়হান ২ হাজার টাকা হারায়। তাতে বেড়ে যায় জিদ। দ্বিতীয় চালে ওই সহযোগী নিজেই তার পক্ষ হয়ে একটি কার্ডে বাজি ধরে। এবার অন্যরা তাতে উৎসাহ জোগায়। আবু রায়হানেরও চালটি সঠিক বলে মনে হয়। কিন্তু কার্ড চালানো মূল জুয়াড়ির এক শর্ত ‘আগে টাকা ফেলতে হবে। টাকা না রেখে বাজি ধরা যাবে না। টাকা ফেললেই কার্ড উঠানো হবে।’ তাকে কেউ টাকা ফেলে সবাই আবু রায়হানকে বাজি ধরতে বলে। কথা মতো আরো ২ হাজার টাকা রাখেন আবু রায়হান। কার্ড উঠাতেই হারান সেই টাকাও। এবার তিনগুণ লাভ দেয়ার ঘোষণা মূল জুয়াড়ির। সেই ‘ত্রাণকর্তা’ আবারও মূল কার্ডটির কোনা ভেঙে দিয়ে ইঙ্গিত করেন। এবার শেষ সম্বল বাকি ১ হাজার টাকা বাজি ধরেন। কার্ড উল্টাতেই হারান তাও। তার কাছে আর টাকা নেই দেখে দ্রুত খেলা গুটিয়ে ফেলে মূল জুয়াড়ি। আশপাশে আর কোনো খেলোয়াড় নেই। হতভম্ব আবু রায়হান উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এই দাঁড়াও। যাবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একজন খোঁচা দিয়ে বলে, এই আপনি ভদ্রলোক। তাদের সঙ্গে পারবেন না। এখানে সবাই তাদের লোক। জুয়া খেলতে গেলেন কেন। এরা জুয়াড়ি। এদের কাছে কাল সাপ আছে। বাড়াবাড়ি করলে আপনার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ছোবল মারাবে। মোবাইলও কেড়ে নেবে। ঘাড় ফিরিয়ে কিছুক্ষণ সে কথা শুনতে শুনতে সামনে তাকাতেই উধাও মূল জুয়াড়ি ও বাজারের ব্যাগসহ লোকটি। শেষে রক্ষাকর্তার অভিনয়ে এগিয়ে আসা লোকটি বলে, এদিকে আসেন। আমি আপনাকে পার করে দিচ্ছি। তার সঙ্গে আরো দু’জন। দ্রুত সরে যান এখান থেকে। তারা এর আগের জুয়ার আরো কয়েকটি ভয়ঙ্কর গল্প বলতে বলতে আবু রায়হানকে কিছুটা এগিয়ে দেয়। তা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সরল মনে বিশ্বাস করতে করতে মোবাইল আর প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে চলেন তিনি। কিছুটা এগুতেই ওই লোকগুলো অন্যদিকে চলে যায়। এরপর এক দোকানদার কি হয়েছে জানতে চায়। তখন আবু রায়হান সব বলতেই ওই দোকানদার বলে আপনাকে এগিয়ে দেয়া তিনজনও একই দলের সদস্য। তখনই জুয়ার ভয়ঙ্কর ফাঁদের সব অভিনেতার চরিত্র পরিষ্কার হয় জুয়ায় অন্যের উপকার করতে যাওয়া আবু রায়হানের।
গত শুক্রবার বিকাল ৪টায় জুয়ার এমন ফাঁদে আটকা পড়েন পথচারী শফিকুল ইসলাম। অভিনয়ের ধীরে তাস চালানোর পাতানো জুয়া কিছুক্ষণ দেখতে দেখতেই এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর আত্মবিশ্বাস জন্মে। এ চালে নিজেও ১ হাজার টাকা বাজি ধরে। পেয়ে যায়। এরপর ২ হাজার টাকা হারায়। অপর চালে ২ হাজার টাকা হারায়। এরই মধ্যে এক পুলিশ সদস্য লাঠি হাতে গলি বেয়ে রেললাইনে উঠতেই জুয়াড়িরা লাপাত্তা। চার হাজার টাকা হারিয়ে ওই স্থান ছাড়েন শফিকুল ইসলাম।
৫ হাজার টাকা হারানো আবু রায়হান বলেন, আসলে আমি কখনো নেশা বা জুয়ায় জড়াইনি। প্রায় সময় এই রেললাইন ধরে যাওয়া আসায় জুয়ার আসরে লোকের জটলা দেখি। ফিরেও তাকাইনি। হঠাৎ ওই লোকটার কথা শুনে এবং কম লোক দেখে মনে দয়া হলো। উপকার করতে গিয়ে দেখি এটা তো তাদের ফাঁদ।
গত শুক্রবার দুপুর। এফডিসির বিপরীতে অপর এক জুয়াড়ি প্রায় একই কায়দায় জুয়ার আসর বসায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সৈনিক নামে এক পথচারীর ৭ হাজার ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেয়। শেষের দিকে ভুল চালে টাকা হাতিয়ে নেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন সৈনিক। শুরু হয় তর্ক। ততক্ষণে জুয়ার আসরে জুয়াড়ির সহযোগীদের পাশাপাশি বাড়তে থাকে সাধারণ পথচারীদের ভিড়। এ অবস্থায় তর্কের মধ্যেই ওই জুয়াড়ি দৌড়ে ঝূঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পার হয়ে এফডিসির দিকে পালায়। সৈনিকও কিছুক্ষণ পিছু নেয়। না পেয়ে শেষে ফিরে আসে।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, জুয়ার আগের চালগুলোতে আমি হারলেও শেষ চালে আমি জিতি। তখনই মূল জুয়াডি মিথ্যা কথা বলে টাকা রেখে দেয়। তখন দেখি সঙ্গে থাকা লোকগুলোও তার পক্ষ নেয়। এক পথচারী সাক্ষ্য দেয়ার পর আরো কয়েকজন লোক আমার পক্ষ নিলে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ফিরে এসে দেখি সাধারণ পথচারীরা দাঁড়িয়ে থাকলেও আগের দর্শকরা কেউ নেই।
এছাড়া গত এক মাসে কাওরানবাজার ছাড়াও রাজধানীর ফার্মগেট, কমলাপুর রেল স্টেশন, পান্থপথের কয়েকটি স্থানে একইভাবে জুয়ার আসর চোখে পড়েছে। কাওরান বাজার রেললাইনে ঘূর্ণায়মান বোর্ডে চালিত জুয়ার আসরও দেখা গেছে। এসব ছাড়াও রাজধানীর অন্তত অর্ধশতাধিক স্পটে এভাবে প্রতিদিন প্রকাশ্যে জুয়ার ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষের পকেটের টাকা, হাতের ঘড়ি, মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
কাওরান বাজার রেললাইন এলাকায় দীর্ঘ এক যুগ কাজ করেন আবদুর রহমান নামে এক বৃদ্ধ। তিনি বলেন, সাত-আট বছর ধরেই জুয়ার আসর দেখে আসছি। সাধারণ পথচারীকে টার্গেট করে তৎক্ষণাৎ জুয়ার আসর বসিয়ে নানাভাবে ভুলিয়ে সব টাকা হাতিয়ে নেয়। আসরে দু-একজন পথচারী ছাড়া বাকি সবাই তাদের লোক। তারাই বাজি ধরে তারাই জিতে। সব হারায় সাধারণ পথচারীরা। কয়েকশ’ থেকে ৩০ হাজার টাকাও হারায়। প্রতিদিন ২০, ৫০ এমনকি ১০০ লোকও এখানে জুয়ায় সব হারায়। প্রায় সময় নতুন নতুন জুয়াড়িদের দেখি। অনেক মাদকাসক্তও জড়িত। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে বেশি জুয়ার আসর বসে। মাঝে মাঝে কয়েকজন পুলিশ আসে। তখন সবাই লুকায়। একজন এসে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে। টাকা দেয়। পুলিশ চলে গেলে আবার জুয়ার ফাঁদ পাতে।
প্রকাশ:
২০১৭-০৪-২৮ ০৩:১৯:৩৩
আপডেট:২০১৭-০৪-২৮ ০৩:১৯:৩৩
- মেরিন ড্রাইভ সড়কে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নিহত
- চকরিয়ায় সাবেক এমপি জাফর সাঈদি সহ আওয়ামী লীগের ২৮৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় নতুন মামলা
- চকরিয়ায় যাত্রীবাহী বাস থেকে ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধার, বিক্রেতা গ্রেফতার
- দুর্নীতির আখড়ায় কক্সবাজার সিটি কলেজ
- চকরিয়ায় ব্যবসায়ীকে ডেকে নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা ছিনতাই
- বদরখালী সমিতির ১১টি মৎস্য প্রকল্পের নিলাম নিয়ে বিরোধ
- রামুতে আপন ভাতিজিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি
- রামুতে ল্যাপটপ পেলেন ৮০ নারী ফ্রিল্যান্সার
- চকরিয়ায় আওয়ামিললীগ ক্যাডার নজরুল সিণ্ডিকেটের দখলে ৩০ একর বনভুমি:
- চকরিয়ায় শিক্ষা ক্যাডার মনিরুল আলমকে ঘুষের বদলেগণপিটুনি
- চকরিয়ার বিষফোঁড়া সিএনজি-টমটম স্টেশন
- চকরিয়া সদরের বক্স রোড সম্প্রসারণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ
- বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে গেলেন পদত্যাগ করা বিতর্কিত অধ্যক্ষ মুজিবুল আলম
- চকরয়ার ঠিকাদার মিজান গ্রেফতার, কোটি টাকার ঋণের জেল-জরিমানার দায়ে
- কক্সবাজার আবাসিক হোটেলে ৭০ ইউপি সদস্যের ‘গোপন বৈঠক’, আটক ১৯
- চকরিয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, ২টি ডাম্পার ও স্কেভেটর জব্দ
- চকরিয়ার রশিদ আহমদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় : কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে
- রামুতে ট্রেনে কাটা পড়ে মোটর সাইকেল আরোহী দুই যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু
- ঈদগাঁও’র নবাগত ইউএনও বিমল চাকমা
- চকরিয়ার সাবেক এমপি জাফর আলম, সালাহউদ্দিনসহ আওয়ামী লীগের ৭৩৬ জন আসামী
- চকরিয়ায় ব্যবসায়ীকে ডেকে নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা ছিনতাই
- উত্তপ্ত রামু সরকারি কলেজ: অধ্যক্ষ মুজিবের অপসারনের দাবিতে কার্যালয় ও প্রশাসনিক ভবনে তালা
পাঠকের মতামত: